বর্তমানে কন্যা সন্তানের গ্রহণযোগ্যতা হয়ত বাড়ছে, কিন্তু মেয়েদের প্রাপ্য সম্মান কি দেয়া হচ্ছে? কখনো কখনো পরিবার ও আত্মীয়রাও যে মেয়েদের শত্রু৷ কোনো নারী উন্নতি করলে তাকে নীচে নামাতে উঠে পড়ে লাগে বিভিন্ন স্তরের মানুষ৷
আমার জন্মের ঘটনাটি দিয়েই শুরু করি৷ আমার জন্ম হয় মামা বাড়িতে৷ খবর পেয়ে আমার বাবা মা'র জন্য একটি আংটি নিয়ে আমাকে দেখতে যান৷ মা সেই আংটিটি ছুড়ে ফেলেন, কারণ, তিনি চাইছিলেন একটি পুত্র সন্তান৷ তার বড় সন্তানটিও কন্যা৷ এই চিত্রটি কিন্তু খুব বেশিদিন আগের নয়৷ বর্তমানেও এই চিত্রের খুব একটা বদল হয়নি৷ অর্থাৎ পরিবারেই যেখানে মেয়েরা অপ্রত্যাশিত, সেখানে মেয়েদের প্রতি সমাজে সম্মান তো দূরের কথা, গ্রহণযোগ্যতা কীভাবে তৈরি হবে? কীভাবে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে?
প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার পথে বখাটে কিছু ছেলে বিরক্ত করত এক বান্ধবীকে৷ দেখে ফেললেন বান্ধবীর এক প্রতিবেশী, ততক্ষনাৎ মেয়েটির বাবার কানে দিলেন সে খবর৷ সেই প্রতিবেশীর বক্তব্য ছিল, মেয়েটির আশকারা পেয়ে ছেলেগুলো এমন করছিল৷ বাবা কিন্তু মেয়ের কোনো কথা শুনলেন না৷ মেয়েটিকে বকা দেয়ার পাশাপাশি বলে দিলেন আর প্রাইভেটে যাওয়ার দরকার নেই, বাসায় বসে পড়লেই চলবে৷ মেয়েটির কোনো দোষ না থাকলেও সব দিক থেকেই ভুক্তভোগী মেয়েটি৷
পরিবার সম্পর্ক মেনে না নেয়ায় আমার দূর সম্পর্কের এক বোন এক প্রতিবেশী মুসলিম ছেলের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল৷ ৬ মাস পর তাকে যখন বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হলো, তখন সে অন্তঃসত্ত্বা৷ ঐ অবস্থায় মেয়েটিকে শারীরিক হেনস্তা তো করা হলোই, সিদ্ধান্ত হলো, সন্তানটিকে এ পৃথিবীতে আসতে দেয়া হবে না৷ ডাক্তার জানালেন, এ অবস্থায় তা ঝুঁকিপূর্ণ৷ কিন্তু পরিবার পিছু হটলো না৷ গর্ভপাতের পর মেয়েটি অনেক কষ্টে বেঁচে উঠলো৷ এরপর বিয়ে দেয়া হলো স্ব-ধর্মের ছেলের সঙ্গে৷ কিন্তু সেই সংসার খুব এটা সুখের হয়নি৷ পরিবার কি পারতো না মেয়েটিকে ঐ ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে? ধর্মের কারণে মেয়েটির জীবন ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতেও তারা দ্বিধা করেনি৷
সমাজ যে একটা মেয়েকে কী চোখে দেখে একটা ঘটনা বললেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে৷ আমাদের পরিচিত এক আন্টি এয়ারহোস্টেসের কাজ করতেন৷ যথারীতি তাকে বিভিন্ন দেশে দেশে ঘুরতে হতো৷ তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবচেয়ে মেধাবী৷ আর পরিবারটি দরিদ্র৷ সেই আন্টি চাকুরি করে পরিবারে স্বচ্ছ্বলতা আনলেন, পাশাপাশি ভাইয়ের ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার খরচ চালানোর দায়িত্ব নিলেন৷ সারা জীবন বিয়ে করলেন না, যদি পরিবারের দায়িত্ব না পালন করতে পারেন এই ভয়ে৷ এত ত্যাগের পরও তাকে কী শুনতে হলো জানেন? তাঁকে শুনতে হতো, ‘‘কীসের এয়ার হোস্টেস! বিভিন্ন হোটেলে গিয়ে অনৈতিক কাজ করে অর্থ উপার্জন করেন তিনি৷ আর সেই টাকায় চলে তার পরিবার৷'' এই তাঁর আত্মত্যাগের মূল্য! এই কাজটিই যদি তার কোনো ভাই করতেন, তাহলে হয়ত পুরো সমাজ তাঁকে মাথায় করে রাখত৷
আমাদের দেশে একটি মেয়ের জন্ম নেয়া এবং বেড়ে ওঠা যেন পাপ৷ তার ভালোবাসা পাপ, ইচ্ছেমতো কাপড় পরা, চলাফেরা কথা বলা সবটাতেই বাধা৷ সম্প্রতি ভারতের ‘পিংক' সিনেমাটি দেখে আবারো উপলব্ধি হলো৷ আমাদের সমাজেও ছেলেরা নিশ্চয়ই এটাই ভাবে, ছেলেদের গায়ে হাত দিয়ে কথা বললে, একটু আধুনিক পোশাক পড়লে, হেসে কথা বললেই সেই মেয়েটি ‘খারাপ'৷ বিশেষ করে মফঃস্বল শহরে তো এমন করলে ঢি ঢি পড়ে যায়৷ বাড়ি বয়ে মানুষ কথা বলতে আসে, দেখলাম, আপনার মেয়ে রাস্তায় ছেলেদের সঙ্গে কথা বলছে হেসে৷ পাশের বাড়ির আন্টি বলবে, আজ দেখলাম আপনার মেয়ে প্যান্ট শার্ট পরে বের হলো৷ ছেলেদের মতো ছোট ছোট চুল রেখেছে কেন?
সব কিছুতেই তাদের কথা বলা চাই৷ আর পরিবারে যদি কোনো পুরুষ না থাকে, তাহলে তো পরামর্শ দেয়াটা যেন প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের অধিকারের মধ্যে পড়ে! আপনার মেয়ের বয়স হয়ে গেলো এখনও বিয়ে হলো না? প্রেম করছে নাকি? বাসায় কোন পুরুষ (বাবার বন্ধু, দিদির বন্ধু) এলে কে এসেছিল, কেন এসেছিল? প্রশ্নে জর্জরিত মা৷
শেষ করব আমার কথা বলে৷ না কোনো সহানুভূতি পাওয়ার আশায় নিজের কথা লেখা নয়৷ বরং পরিস্থিতি বোঝাতে এই কথাগুলো লেখাটা জরুরি৷ বাবা যখন মারা যান, আমার বয়স তখন মাত্র ৯ বছর, দিদির ১১ আর মা'র ৩২৷ আমার মা আমাদের আগলে বড় করেছিলেন৷ নিজের সুখ-স্বাচ্ছ্বন্দ্যের কথা ভাবেননি৷ আমার মামারা বলেছিলেন মা'কে আবার বিয়ে করতে৷ তাঁরা হয়ত ভেবেছিলেন, আমরা তাঁদের ঘাড়ে চেপে বসব৷ নানারকম ভয়ভীতি দেখানো হলো মাকে, বোঝানো হলো, সামনে কত সমস্যায় পড়তে হবে৷
মেয়েদের তো পরজীবী, পরনির্ভরশীল হওয়া ছাড়া যেন আর কোনো উপায় নেই! আমার মা বাড়িতে বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করলেন, পাশাপাশি সেলাইয়ের কাজ৷ আমরা দুই বোন মাকে সাহায্য করতে লাগলাম৷ বাবা অসুস্থ থাকাকালীন বিদ্যুৎ বিল না দিতে পারায় আমাদের বাড়ির বিদ্যুতের সংযোগ কেটে দেয়া হলো৷ এক বছর পর আমার এসএসসি পরীক্ষা৷ এসএসসিতে দিদি ভালো রেজাল্ট করলো, আমি হলাম বৃহত্তর জেলায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম৷ আলোহীন আমাদের পরিবারে কিছুটা হলেও আলো ফুটল৷ আমি আর দিদি বেশ কয়েকটি টিউশনি পেয়ে গেলাম৷
উচ্চমাধ্যমিকের পর ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ একটি টিউশনি জুটল, অল্প কিছু টাকা পাঠাতে পারতাম বাসায়৷ প্রতিদিন খেতাম বান রুটি আর কলা৷ হল থেকে ধানমণ্ডি যেতাম পায়ে হেঁটে৷ কয়েক মাস পর ইংলিশ মিডিয়ামের দু'টো বাচ্চা পড়ানোর সুযোগ এলো৷ তখনকার দিনে বেশ ভালো টাকা পেতাম পড়িয়ে৷ কয়েক মাস পর বাড়ি গিয়ে বিল পরিশোধ করে বিদ্যুত ফিরিয়ে আনা হলো৷ প্রতিমাসে বাড়িতে টাকা পাঠানোর অঙ্কটা বেড়ে গেলো৷
এবার আত্মীয় প্রতিবেশীদের আর ভালো লাগলো না৷ উঠে-পড়ে লেগে গেলেন আমাকে নীচে নামাতে৷ হ্যাঁ, তারা আমাকে নিয়ে মা কে যা বলেছিল একটা মেয়ের জন্য এর চেয়ে হীন আর কিছু হতে পারে না৷ তারা আরও বললেন, যেসব মেয়েরা হলে থাকে, তারা এমনই! অর্থাৎ ‘খারাপ'৷ আমার মা কাঁদতে লাগলেন৷ কিন্তু আমার কান্না পেলো না৷ এত দিনের কষ্ট যেন আগুন ঝরালো আমার চোখে৷ সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলাম তাদের সঙ্গে৷ কথায় বলে, ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো'৷ না, সেই দুষ্ট গরুরা কিন্তু আমার পিছু ছাড়েনি৷ আমার বিয়ের পর মাকে বললেন, ‘‘তোমার মেয়ে মুসলিমকে বিয়ে করেছে, এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল৷ আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে ভালোই করেছো৷''
এত দুষ্ট মানুষদের মধ্যে যে ভালো মানুষ নেই তা নয়৷ মাকে সাহস দেয়ার মতো মানুষও ছিলেন৷ কিন্তু সমাজে তাদের সংখ্যাটা খুবই নগন্য৷
আমাদের সমাজে পরিবারের সম্মানের জন্য সরাসরি হয়ত কেউ কাউকে হত্যা করে না৷ কিন্তু আত্মঘাতী হতে বাধ্য করে৷ বা একটা মানুষের পুরো জীবনকে ছাড়খার করে দিতে কোনো কার্পণ্য করে না৷ তাই পরিবার যেমন চাইলে একটা মেয়েকে নিজের জীবন গড়তে সাচ্ছ্বন্দ্য দিতে পারে , তেমনি সমাজও পারে তার যোগ্য সম্মান দিতে৷ এজন্য বদলাতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি৷ নেতিবাচক কথা বলার আগে, একবার নিজেকে তার জায়গায় ভাবলেই অনেকটা পরিবর্তন আসতে বাধ্য৷ অমৃতা পারভেজ, ডয়েচে ভেলের ব্লগ থেকে
সূত্র: কালের কণ্ঠ অনলাইন।