রাশেদা কে চৌধুরী
উন্নয়নকর্মী রাশেদা কে চৌধুরীর জন্ম ১৯৫১ সালে, সিলেটে। তাঁর মা সাবিকুন নিসা চৌধুরী ডাক্তার ছিলেন। আর বাবা গোলাম ইয়াহইয়া চৌধুরী ছিলেন কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক। রাশেদা কে চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে স্নাতকোত্তর শেষ করে উন্নয়নকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি ‘গণসাক্ষরতা অভিযান’-এর নির্বাহী পরিচালক। ২০০৮ সালে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ ও এর প্রতিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার, বাল্যবিবাহ, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে তাঁর কথা হয়। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন
শারমিনুর নাহার
কালের কণ্ঠ : চলমান কয়েকটি রিপোর্টে নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ার পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। এ ছাড়া প্রায়ই পত্রিকার পাতায় দেশের কোথাও না কোথাও নারী ও শিশু নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন এতটা বেড়ে যাওয়ার কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
রাশেদা কে চৌধুরী : নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীতে একটি অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করছে বলে বলা হয়। এর জন্য আমরা গর্বিত। কিন্তু সামাজিক উন্নয়নের কতগুলো চিত্র আছে। যেমন—প্রথমত, নারীদের শিক্ষার হার বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, নারীর গড় আয়ু বেড়েছে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নারীরা ক্রমাগত এগিয়ে আসছে। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নারীর অগ্রাধিকার বাড়ছে। এগুলো আমাদের সাফল্য; কিন্তু একটা পর্যায়ে আমরা সবচেয়ে বড় হোঁচট খাচ্ছি, আমি নারী আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবেও মনে করি, আমাদের সব অর্জন একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে যায় যখন দেখি নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমাগত বাড়ছে। এই বাড়াটা কেবল সংখ্যা বা মাত্রার দিক থেকে বাড়া নয়, নির্যাতনের ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। নারী যদি গৃহকর্মী হয়, তাহলে সে যেমন সহিংসতার শিকার, আবার সে যদি ঘরের বউও হয়ে থাকে, তাহলেও সে সহিংসতার শিকার। এটা কোনো ধারণার ওপর ভিত্তি করে নয়। নানা পত্রপত্রিকা বা গবেষণায় এই চিত্রের পাশাপাশি সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ৮০ শতাংশের ওপর নারী কখনো না কখনো ঘরেই নির্যাতিত হয়।
কালের কণ্ঠ : এই নির্যাতন কি আগে থেকেই ছিল, নাকি এখন এসে আমরা এর বৃদ্ধির প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি?
রাশেদা কে চৌধুরী : নির্যাতন কম বা বেশির প্রসঙ্গ নয়, আমার কাছে মনে হয়, নির্যাতনের এই হার সামনে আসার একটা বড় কারণ—সমাজের গতি পরিবর্তিত হচ্ছে। আর যিনি নির্যাতিন হচ্ছেন, তিনি এখন সেটা বলছেন। আগে কখনোই বলতেন না। এখন বলছেন, বিশেষ করে ঘরের নারী। নারীদের জন্য এখন ওয়ানস্টপ সার্ভিস রয়েছে, এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শিশুদের জন্যও হেল্পলাইন চালু করেছেন। এগুলো নারীদের কথা বলার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও কাজ করছে। নারী নির্যাতনের এই চিত্র যেমন আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা তাকে কর্মস্থলে, রাস্তাঘাটে যেমন নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছি, তেমনি ঘরের মধ্যেও তার নিরাপত্তা দিতে পারিনি। নারী কর্মজীবী হলেও তাকে যেমন সন্তান লালন থেকে শুরু করে ঘরের সব দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে, তেমনি তার দায়টাও বাড়ছে। এটা কেবল আমাদের দেশে নয়—ভারত, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় দেশেই একই চিত্র। ভারত গণতান্ত্রিক হওয়ার কারণে সেখানকার আন্দোলনগুলো তীব্র হচ্ছে। কিছুদিন আগে দিল্লিতে যে মেডিক্যাল ছাত্রী বাসে নির্যাতিত হয়েছিল, যার কারণে একটা শক্তিশালী আন্দোলন হলো। এই আন্দোলন সম্ভব হয়েছে শক্তপোক্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠার কারণে। আমাদের দেশে এখনো তেমন শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। যেটা গড়ে উঠেছে তা অত্যন্ত ছাপোষা, সুবিধাবাদী। এটা গা বাঁচিয়ে চলে। কেউ নির্যাতিত হলে তাকেই দোষারোপ করে। এটা আমাদের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতারই ফল।
কালের কণ্ঠ : নারী উন্নয়নের কিছু সাফল্যজনক চিত্র থাকলেও আমরা কিন্তু বাল্যবিবাহ রোধে সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
রাশেদা কে চৌধুরী : ঘুরেফিরে সে কথাটাই বলতে হয়, বাংলাদেশে নারীদের অর্জনের জায়গা যেমন দৃশ্যমান, নারীর ঝুঁকিপূর্ণ সামাজিক অবস্থানও অনেক বেশি দৃশ্যমান। সেটা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান নারীদের কৈশোরে। বাংলাদেশের মেয়েদের সত্যি কৈশোর বলে কিছু নেই। একটা ছেলে মাঠে খেলতে পারছে; কিন্তু যখনই একটা মেয়ে কৈশোরে প্রবেশ করছে তখনই তাকে একটা গণ্ডিতে বেঁধে ফেলা হচ্ছে। এর কারণ, ১. পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা, ২. নিরাপত্তাবোধের অভাব। বর্তমানে বাল্যবিবাহের প্রবণতায় গোটা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ একটা লজ্জাজনক অবস্থানে আছে। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া নয়, বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর অনেক কারণের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী কারণ হলো, মা-বাবা মনে করছেন, এটাই তাঁদের মেয়েকে একমাত্র নিরাপত্তা দেবে; যদিও নারীর পড়ালেখার সুযোগ রাষ্ট্র দিন দিন বৃদ্ধি করছে, তার কাজের ক্ষেত্র বাড়ছে, কিন্তু অভিভাবকদের কাছে তাঁর সন্তানের নিরাপত্তাই সবচেয়ে বড়। সেখানে তাঁরা কোনো ছাড় দিতে চান না। আমার কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, যখন আমার এলাকায় গিয়ে কিশোরীদের সঙ্গে আলাপ করি (প্রসঙ্গটা ছিল মাধ্যমিকে মেয়েশিশুর ঝরে পড়ার হার বেশি কেন?)। একটা কিশোরী দেখলাম, সে পঞ্চম শ্রেণি সমাপনীতে বৃত্তি পেয়েছে, নিয়মিত উপবৃত্তিও পায়; কিন্তু সে অষ্টম শ্রেণি পাস করতে পারেনি। খুব অবাক হলাম, তার কাছে ফেল করার কারণ জানতে চাইলাম। সে বলল, ‘আমি তো স্কুলেই যেতে পারেনি, পাস করব কিভাবে?’ কেন স্কুলে যেতে পারোনি? তখন সে বলল, ‘যখন বাজারের পাশ দিয়ে স্কুলে যেতাম তখন বখাটেরা উত্ত্যক্ত করত। এটা এসে বাপজানকে বললাম, বাপজান বলল, প্রতিদিন যাওয়ার দরকার নেই, যেদিন আমি হাটে যাব, সেদিন স্কুলে যাবি।’ এই হলো বাস্তব অবস্থা। সুতরাং মেয়েদের অসম্ভব রকমের স্পৃহা থাকা সত্ত্বেও আমরা সেটিকে কাজে লাগাতে পারছি না। এখানে অভিভাবকরাও খুবই অসহায় বোধ করেন। অসহায় বোধ করার বড় কারণ, সহিংসতার মাত্রা এবং প্রকারটা এখন ভয়ানক আকার ধারণ করছে।
কালের কণ্ঠ : সমাজে যারা সহিংসতা করছে তারা কারা, এর কারণ কী?
রাশেদা কে চৌধুরী : হয় তারা বিত্তশালী, নয় রাজনৈতিক দলের লোকজন। ফলে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। আর অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার মতো খারাপ সংস্কৃতি কোথাও নেই। কারণ অপরাধী যখন জানছে যে কোনো না কোনোভাবে আমি পার পেয়ে যাব তখন সে অপরাধ করবেই। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বে এগুলো শক্ত হাতে মোকাবিলা করা যাচ্ছে না। কারণ সে বাস্তবতা আমরা এখনো তৈরি করতে পরিনি। বর্তমানে সহিংসতা বাড়ার তিনটি উপসর্গ আছে : ১. আকাশ সংস্কৃতি, দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর যে চ্যানেলগুলো চলে, সেখানে মূল্যবোধের অবক্ষয়কে হালাল করা হয়, এটা দেখে তরুণরা শিখছে। ২. তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার, সেটা মোবাইল হোক, ইন্টানেট হোক। নতুন প্রজন্মের মধ্যে, বিশেষ করে কিশোরী ছেলেমেয়েরা যখন প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পায় তখন তাদের সামনে একটা নতুন দুয়ার খুলে যায়। ভালোমন্দ বিচার করার আগেই তাকে অপব্যবহারের শিকার হতে হয়। এখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তা হলো—যাদের আমরা কিশোরী বলছি, তাদের মধ্যে অন্তত ৩০ শতাংশের বেশি শিক্ষা নিতে আসা প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। ফলে তাদের মা-বাবা জানেন না কিভাবে ছেলেমেয়েদের সাবধান করতে হবে। ভালোমন্দ বিবেচনা করার সেই সুযোগ তাঁদের নেই, সামর্থ্যও নেই। তাই তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহারের সুযোগে কিশোরীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। ৩. অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়া। গত কয়েক মাসের অবস্থাটাই যদি দেখি—আমরা তনু হত্যার বিচার পাইনি। এত বড় একটা ঘটনার কোনো কিছুই আমরা করতে পারলাম না? এ যে জাতি হিসেবে কত বড় কলঙ্ক, তা বলে বোঝাতে পারব না। একটা মেয়ে নির্যাতিত হয়েছে, এরপর তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। দ্বিতীয়বার তার লাশ তোলা হলো; কিন্তু কিছুই হলো না। এটা নিয়ে সারা দেশে তুলকালাম কাণ্ড হলো; কিন্তু পরে কী হলো? বিচার কি পেলাম? এরপর রীশা হত্যা, শিশু রাজন হত্যা। রাজনের আসামিকে আমরা পার করে দিই। পরে জেদ্দার বাংলাদেশিরা তাকে ধরিয়ে দেয়। রীশা হত্যাকারী যে দর্জি, তাকেও জনগণ ধরে দিয়েছে। ফলে দেখতে পাচ্ছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক নয়, জনগণই আসামিকে ধরছে। আবার খাদিজার ঘটনাটাও খুবই দুঃখজনক। আসামি রবিউলকে একই অপরাধে ২০১২ সালে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়। সে সময় যদি রবিউলের যথাযথ বিচার হতো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি তত্পর হতো, রাজনৈতিক দল যদি তাকে বাদ দিত, তাহলে আবার একই ঘটনা ঘটত না। এটা আমাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। কেন পারলাম না? রবিউলের আগের ঘটনার সময় যারা তাকে ধরিয়ে দিয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তাদেরই দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
কালের কণ্ঠ : এসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যখন মৃত্যুদণ্ডের আইন করা হলো তখন এর মাত্রা কমে এলো। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য কি এমন কোনো আইন করা যেতে পারে?
রাশেদা কে চৌধুরী : নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে দেশে যে ধরনের আইন আছে, সেগুলো খুবই কড়া। এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারলে এত সমস্যা হতো না। সর্বোচ্চ শাস্তির চেয়েও বেশি প্রয়োজন দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করা। এসব মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যেতে হবে। যতই দীর্ঘসূত্রতা হবে ততই অপরাধ বাড়বে। এসিড-সন্ত্রাস ঠেকানো গেছে কতগুলো সর্বোচ্চ শাস্তির বাস্তবায়ন করে। অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে হয়তো সেটিও করতে হবে। কিন্তু মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আমি মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করি না। যেসব ক্ষেত্রে মানুষ অমানুষ হয়ে যায়, সেসব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতেই হবে।
কালের কণ্ঠ : নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধে কি সামাজিক প্রতিরোধ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে?
রাশেদা কে চৌধুরী : তনু নিয়ে তো কম আন্দোলন হয়নি! মিডিয়া জানে কি না জানি না, তনুর মাকে মিডিয়ার সামনে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। এখন তিনি লুকিয়ে থাকেন। এসব নির্যাতন প্রতিরোধে শক্ত রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার। অন্যরা এগিয়ে আসছে না—এটা খাদিজার ক্ষেত্রে সত্য ঘটনা। আগে অন্যরা এসেছে। যারা এসেছে, তাদের পরে ফাঁসানো হয়েছে। পরে অবশ্য দেখা গেছে, ছাত্রলীগের ছেলেরাই কিন্তু রবিউলকে ধরেছে। কাজেই সমাজের সব কিছু যে খারাপ হয়ে গেছে, তা নয়। এমন ঘটনা তো ঘটেছে যে ইভ টিজিংয়ের হাত থেকে স্কুল ছাত্রীকে বাঁচাতে শিক্ষক প্রাণ দিয়েছেন। যেখানে আমাদের সম্মানিত সংসদ সদস্য শিক্ষককে লাঞ্ছিত করেন, সেখানে মানুষ অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আগে নিশ্চয়ই চৌদ্দবার ভাববে।
কালের কণ্ঠ : শিশুরা ঘরেই নির্যাতিত হচ্ছে, নারীর মতো পরিবারেও তার নিরাপত্তা নেই। এটা কিভাবে রোধ করা যাবে?
রাশেদা কে চৌধুরী : সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পাশাপাশি মানসিক বিকৃতিও প্রচণ্ড মাত্রায় বেড়েছে। ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে মানুষের অহংকারের বিষয় আছে। মাদকাসক্তি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে নষ্ট করে দিচ্ছে। আমরা সামাজিকভাবে ব্যর্থ হচ্ছি শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এটা শিশুর অধিকার। কিন্তু সে ঘরে ও কর্মস্থলে নির্যাতিত হচ্ছে। শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে আমাদের এক ধরনের নীরবতা আছে, বিশেষ করে যারা শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে, তাদেরও এই দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর এটা ছেড়ে দিলে চলবে না। যারা সরকারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে আছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আছে, এমনকি আমরাও যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করি তাদেরও শিশুদের প্রতি নির্যাতনের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। আমি রাজন হত্যার দৃশ্য ভিডিও করব, অথচ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসব না—এটা তো হতে পারে না। এই জায়গাগুলোতে আমাদের একদিকে ব্যক্তি, অন্যদিকে সমাজ ও রাষ্ট্র—তিনটি জায়গায় মনমানসিকতা পাল্টাতে হবে।
কালের কণ্ঠ : নির্যাতন প্রতিরোধে পরিবার ও সমাজের করণীয় কী?
রাশেদা কে চৌধুরী : অনেক কর্তব্য আছে। বিশেষ করে পরিবার তো সাহায্য-সহায়তা নিতে চায় না। ঢাকা শহরে কেউ সাহায্যই নিতে চায় না। বলা হয়, চুপ থাকো। আর সমাজের একটা বাজে প্রবণতা হলো, যে নির্যাতনের শিকার তাকেই দায়ী করা হয়। পহেলা বৈশাখের ঘটনায় দেখা গেল একই প্রবণতা—এটা ভয়াবহ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। একেবারে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সবাই বলতে থাকল, দোষটা মেয়েদের, এমন ঘটনা ঘটার জন্য তারাই দায়ী। এটার একটা গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। যেকোনো ছেলের মতো যেকোনো মেয়ে বাইরে গেলে তার নিরাপত্তা রাষ্ট্রকে দিতে হবে। সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের অধিকার এবং স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার—এটা মানুষের মৌলিক অধিকার। আমাদের এখনো এই ধারণায় সমস্যা আছে। আমাদের যে প্রত্যাশা—আমরা মধ্যম আয়ের দেশে যাব। কিন্তু মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়ার জন্য আমাদের অধিকার, সামাজিক বৈষম্য, নারী-পুরুষের বৈষম্য—এগুলোর লাগাম টানতে হবে। এটা নিয়ে আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই, পরিকল্পনাও নেই। সামাজিকভাবে স্থানীয় প্রশাসন শক্তিশালী করতে হবে। স্থানীয় সরকারেও নারী নেতৃত্ব আছে। তাদেরই এ জায়গায় নড়েচড়ে তত্পর হওয়া উচিত। কারণ আমি জানি, বিভিন্ন ইউনিয়নে যেসব তত্পর নারী সদস্য আছেন, তাঁদের কারণে এলাকায় বাল্যবিবাহ হয় না। এটা তাঁরা বন্ধ করে দিতে পেরেছেন। আমরা ঢাকায় বসে এটা করতে পারছি না। রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও স্থানীয় প্রশাসনকে উৎসাহিত করতে হবে। তারা ভোটারদের কাছে বাধ্য, প্রশাসনও তাদের কথা মেনে চলবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ মেয়েরা এখন পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। তাই শিক্ষকদের উচিত তাদের সচেতন করা। বেশি নয়, কেবল দুজন শিক্ষকই এটা করতে পারেন। মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল শিখিয়ে দিতে পারেন। কলসিন্দুরের মেয়েরা যদি পারে, তাহলে অন্যরা কেন পারবে না? শিক্ষকদের মধ্যেই আছে চেঞ্জমেকার। মানুষ প্রথমে হয়তো মানতে চায় না। কিন্তু যখন দেখে এটা পজিটিভ তখন মেনে নেয়। হয়তো একটু সময় লাগে; কিন্তু এভাবেই এগোবে। সমতার কথা বলা সহজ; কিন্তু তাকে ধারণ করে সে অনুযায়ী কাজ করাটা কঠিন।
কালের কণ্ঠ : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
রাশেদা কে চৌধুরী : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।
#কালের কণ্ঠ অনলাইন হতে সংগৃহিত।